বুনো
কচুর ঢাউস পাতা
গৌরাঙ্গ শ্রীবাল
উৎসর্গ
:
মেয়েকে
জোনাকি আমার মেয়ে
তার আলোয় দেখি জীবন-মরণের
মুখ
পারাপারের রাস্তা
খুঁজে পাই
রচনাকাল
: ২০১৮ খ্রিস্টাব্দ / ১৪২৫ বঙ্গাব্দ
চিতা
জতুগৃহের থেকেও তোমার উষ্ণতা
অনেক অনেক বেশি,
আমার সমস্ত দেহ মন ঘর ও সংসার পুড়ে যায়।
রাশি রাশি দেহভস্ম দিয়ে লেখা হয়
নতুন মহাভারত।
তোমার আমার মাঝখানে জেগে ওঠে প্রেম:
একখণ্ড সূচ্যগ্র মেদিনী,
শুরু হয় কুরুক্ষেত্র।
তোমার আগুনে আজো জ্বলে
বিজেতা ও পরাজিত সেনাদের চিতা
দু’হাতে বুকের কাছে মদনভস্মের
ছাই আগলে বসে থাকে
তাদের জন্মান্ধ গুরুজন।
মাটির বীণা
এখনো মাটির বীণা তার
পড়ে আছে একাকী নদীর পাড়ে
গায়ে লেগে আছে মেটে গন্ধের সলাজ হাসি।
শারদ ভোরের সে বীণায়
তার আঙুলের স্পর্শ দেখি
সুরে সুরে নদীর নূপুর বাজে দূরে।
মাকড়ের জালের উপর কুয়াশার জল
যেন ছেঁড়া ছেঁড়া সূক্ষ্ম তাঁতের কাপড় ভিজে
পড়ে আছে প্রসন্ন কাশের বনে।
জন্মান্তরের দাগ
বাড়ির ভিতর থেকে দেখা যায় আমার পড়ার ঘর
দেয়ালের পেরেকে ঝোলানো আছে পুরোনো গিটার।
গিটারের মালিক আমার ছোটো মামার মৃত্যুর পর
শিখেছিলাম ক’দিন,
এখন নিজেই বাজে
তারের ধ্বনিতে তার লঘু সংগীতের সুর।
কাঠের দেহের গর্ভে অন্ধকার
সংসার পেতেছে টিকটিকি, সাদা সাদা
ডিম।
সুরের উষ্ণতা ছুঁয়ে সেইসব ডিমের খোলক ভাঙে
আবার সরীসৃপের জন্ম হয়,
নিঃশব্দে নীরবে বইপোকারা আমার
খাতার পাতায় তীক্ষ্ণ দাঁতের কামড়ে রেখে যায়
স্বরলিপির জন্মান্তরের দাগ।
ভোর
তোমার কস্তূরী রং ছুঁয়ে উঠে আসে
ঊষামুখী ভোর আর বাতাসে হরিণী গন্ধ
মনের ওপারে জল এপারে আমার সাঁতারের শব্দ, তীরে
শীতল আগুন জ্বেলে পেতে আছি শিকারের ফাঁদ।
এবার তোমাকে ছুঁয়ে যে স্পর্শের আভা পাই
সে এক দুর্মর জীবনের সুর, বনের
পালকে কিংবা
ঝরে পড়া বাকলের, নতুন
পাতার সম্ভাবনা দেখে
সে সুরের ঘন জালে জড়িয়ে পড়েছে চাঁদ।
ওদিকে তাকিয়ে থেকে
আমার কপালে ঠোকাঠুকি লাগে তোমার কপাল,
তখনি সুযোগ বুঝে চাঁদ তার জ্যোৎস্না নিয়ে
হরিণের মতো দ্রুত লাফ দিয়ে ডুবে গেল
আকাশ নদীর জলে।
যোনির চিহ্ন
সহস্র যোনির ভিড় থেকে
তোমার জনন চিহ্নটিকে খুঁজে নিতে একটুও ভুল
হয় না আমার, আমি ওই চিহ্ন থেকে
ব্রহ্মাণীর গায়ের ভোরের গন্ধ ভেসে আসে দেখি
এ যোনি যেন ব্রহ্মের নিজের হাতের স্পর্শ দিয়ে
তৈরি
ভালো করে দাবা ময়দার মতো নরম সৌন্দর্য।
চিহ্নটিকে ভরা গাঙ মনে করে বুকের তৃষিত
মরুভূমির বালির উপর দাঁড়াই,
জলে ভিজে যায় হাত,
চাঁদের আলো যেমন ছিল
তেমন তারার পুঞ্জ, কুঞ্জে
কুঞ্জে সারারাত পাখিরা ঘুমিয়ে
ভোরের বেলায় দেখে
তোমার যোনির দাগ মুছে গেছে শিশিরের ঘন
সিক্ততায়।
বেঁচে থাকার সুমিষ্ট স্বাদ
নিতম্বে জড়ানো বুনো কচুর ঢাউস পাতা
কলা পাতা ঢেকে আছে বুক
তোমাকে দেখাচ্ছে যেন
সমুদ্র সৈকতে ঘুরে বেড়ানো বিকিনি পরা সানি
লিওন অথবা কোনো আদিবাসী অগোছালো সন্ধ্যার
যুবতী।
তোমাকে বড়োই প্রয়োজন আজ
দু’টাকা কেজি দরের চাল, গম, বিদ্যুতের আলো আর
কতদিন আমাকে বাঁচিয়ে রাখে,
এই সাড়ে তিন হাত জীবনের সুস্থতার লক্ষে গড়ে
ওঠা
এত বড়ো বড়ো হাসপাতাল আমার জন্য নয়।
আমার জন্য তো তুমি
এখন তোমাকে দেখে রোজ অনুভব করি
যৌনতার উত্তেজনা, সারা দেহে
মনে বেঁচে থাকার সুমিষ্ট স্বাদ।
ভুলে যাই খাদ্যের অভাব আর মাথার উপরে ছাদ,
ছাদের উপরে নীল আকাশ এবং
স্বপ্নের ভিতরে ঘুম।
মাশুল
মায়ার সংসারে আমি অলিখিত সাদা কাগজের মতো:
শরতের মেঘের আকাশ থেকে ছটাক সিঁদুর ধার করে
রাঙিয়ে দিয়েছি ওই না রচিত কবিতার খাতা,
যেখানে তোমার কথা থেমে আছে যেন
স্রোতের গতি হারানো নদী।
তোমার সময় যদি থাকে
তাহলে দুজনে চলি চল সেই কবিতাপাতার কাছে, যার
লতায় জড়িয়ে ভাষাগুলি সব সেতু হয়ে শুয়ে থাকে
হৃদয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে।
কখন বিপদ এসে কথা ভেঙে দেয়
মর্মের আবেগে দেখি সে খাতার পাতাগুলি পচে
গিয়ে
বেরিয়ে পড়েছে কবিতার যত দুর্মর কঙ্কাল
পাঁজর করোটি অস্থি। তারাও আমাকে মনে করে
আমার এ শূন্যতায়
দুটি গেঁয়ো হরিণ নিবিড় সংগমের শেষে ফেলে গেছে
রক্ত লাগা সিঁদুরে মেঘের খামে মোড়া মৃদু
নাভির সলাজ গন্ধ,
আমাকে মেটাতে হবে হরিণীর যোনির মাশুল।
ঘাটশিলা
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির শয়ন-কক্ষে
একটা ঘূণলাগা তক্তপোশে শুয়ে সারারাত
গভীর ঘুম না আসা চোখে স্বপ্ন দেখি:
নতুন বাড়ি করেছি এখানে মাঠের পর মাঠ
দিগন্ত বিস্তৃত শালবন।
শীতলা দেবীর মতো নধর কিশোরী এক
মাঝে মাঝে আমার উঠোনে আসে আবার বনের দিকে চলে
যায়
হাতে থাকে মাঝারি আকারের মহিষ খেদানোর শক্ত
লাঠি।
শরীর গরম মনে হলে
সুবর্ণরেখা নদীতে কোমর ডুবিয়ে আসে
বৃষ্টি ভেজা অরণ্যের গন্ধে ভারী হয়ে যায় সেই
ভূমিজ কন্যার দেহ।
মহিষিণীর যোনিতে মুখ রেখে
বুনো মহিষেরা ঘন গম্ভীর গলার স্বরে পাহাড়
কাঁপিয়ে দেয়
শালের হলুদ পাতা ভাসতে ভাসতে নেমে আসে।
কালির কলমখানি দোয়াতের পাশে রেখে
খানিক বিশ্রাম আর খানিক ভেবে নিচ্ছেন
বিভূতিভূষণ,
প্রতিদিন রাতে গ্রহ তারার অঙ্কুর হয় মাথার
উপর
কে যেন আকাশে ওই ছড়িয়ে দিয়েছে মুঠো মুঠো
নক্ষত্রের বীজ।
বাজি
কতদিন আগে একবার
বাজি ধরেছিলাম যে রাস্তা দিয়ে যাবার সময়
তোমার বাড়ির দিকে তাকাব না।
সংগীত ও নৃত্যের মুদ্রায়
গচ্ছিত করে রাখা আমার আঙুলের নির্দেশিত ছকে
কত বৃষ্টি কত যে শিশির
রোদ ও বাতাস কত নেচে গেছে
এ বাড়ির বারান্দায় দেয়ালে কার্নিশে ছাদে।
বাড়িটাকে আমি আজ যখনি দেখার চেষ্টা করি
বুকের ভিতর থেকে মনে হয়
এক কান্না উঠে আসে তোমার চুলের মুঠি ধরে।
এখন আবার বাজি ধরি এরকম হলে
তোমার মুখের দিকে আর তাকানো যাবে না।
দীপিকা
মানুষের স্বপ্ন দেখা চোখের দীপিকা
মাঝে মাঝে তার শিখা স্থির রেখে ভাবে
সে বুঝি দিনের সূর্য কিংবা রাত্রি নিশীথের
চাঁদ হয়ে গেছে।
তেল ফুরিয়ে গেলে সে তার স্বপনগুলিকে
মৃত নক্ষত্রের মাটি জল বাতাসের হাতে সঁপে দেয়,
নিজে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায় নীরবে ধূপের মতো।
বহুদিন আগে এক মাটির প্রদীপ
বাতাসের হাত থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙে গেছে পৃথিবীর
বুকে,
খণ্ডগুলি নিয়ে আমি জোড়া দিতে দিতে দেখি
স্বপ্ন ঠিক যেন কাক কিংবা পেঁচা অথবা সে এক
হাঁড়িচাঁচা।
বনধ
কৃষ্ণদার মুখে নন্দ ঘোষের ছেলের একশত আট
নামের গুণকীর্তন শুনতে শুনতে
সূর্য ন্যাংটা হয়ে গেল ভোর বেলা, যেন তার
আর এক বার জন্ম হল
সকালে ছড়াল রোদ।
রাধা এসে দাঁড়াল কলসি কাঁখে
নীলিমা রঙের যমুনার
তরঙ্গ তোলা জলের কাছে
কিছুটা জলের সঙ্গে নাচে তার পশরার দুধ।
মোবাইলের রিংটোনে বাজে বাঁশি:
আজ বারো ঘণ্টার স্ট্রাইক
জাতীয় সড়কে দেখি ঢালাই বলের মতো লুটোপুটি খায়
পূর্ণিমা তিথির চাঁদ রাধা ও কৃষ্ণ দুজনে
ছেলেপুলেদের নিয়ে খেলে বসন্তের হোলি।
......
পশমের শাল
শীত কি বিদায় নিয়ে চলে গেছে
পৌষালী, তোমার হাতে বোনা পশমের শাল
এখনো বের করিনি আমি।
অথচ তোমার উপহারের যা কিছু
সব এই বুকে আছে, যে বুক
বাক্সের মতো
তালাচাবি বন্ধ হয়ে পড়ে আছে বহুদিন।
যখন গ্রীষ্মের প্রয়োজনে মন খুলে দুটো কথা বলি
দেখি বর্ষা এসে গেছে, আবার যখন
আমার শীতের দরকার হয়
উঠোনে তখন ঝরে পড়ে মহুয়ার ফুল।
তোমাকে মহুয়া বলে ডাকার গভীর ইচ্ছা ছিল
বসন্ত কি এসে গেছে,
পাখির খাঁচাটা খুলে দিতাম তাহলে।