আমরা 'স্মরণ' লিখতে চাই না। লিখতে চাই না ' আত্মার শান্তি হোক'। আমরা খুব দুর্বল। ভয় পাই। কষ্ট পাই। যন্ত্রণা পাই। আমরা অনুভব করি, যাঁরা লেখেন, তাঁদের সকলের সঙ্গে আমাদের বেশ কিছু তন্ত্রী যুক্ত। একটা সময় মনে হতো, প্রতিটি মৃত্যু হয়ত আমাদের নিজেদের-ই মৃত্যুভয়ের কাছে নিয়ে আসে বলেই এত মর্মান্তিক লাগে। যেমন মনে হত এই যে আয়নায় নিজেদের ছায়া দেখছি, প্রতিবিম্ব দেখছি, এটাই কি আমি? গোপনে, কেউ লিখে যাচ্ছে আমাদের মতো চরিত্রগুলিকে নিয়ে। গোপনে। কোনও এক আবছায়া ঘেরা বারান্দায় হয়ত সে রয়ে গেছে এক চিরহেমন্তকালের বিকেলে। হয়ত তার নিজের মন খারাপ খুব। হয়ত সেও রোদ্দুরের মতো ঝরে পড়তে চায়। কিন্তু এক অধরা কুয়াশার মধ্যে কিছুই সেও দেখতে পাচ্ছে না। একটু একটু করে কুয়াশা সরিয়ে যখন সে নিজের লিখিত জগতের দিকে তাকাচ্ছে, তখন সে দেখছে কী গভীর নির্মম নীরব দুঃখ শুয়ে আছে! থমথম করছে আলো। মধ্যরাতে চলে গিয়েছিলেন কবি পিনাকী ঠাকুর। এত তাড়াতাড়ি কেউ চলে যায়? কিন্তু তিনি নিজেও তো যেতে চাননি। লড়াই করেছিলেন শেষ বেশ কয়েকটা দিন। কারণ হয়ত অনেক কথা বলা বাকি ছিল তাঁর। হয়ত অনেক কথার ভিতরে গুনগুন করছিলেন তিনি। সেই সব কথা হয়ত তাঁকেই বেছে নিয়েছিল তাদের আধার হিসেবে, তাদের প্রকাশক হিসেবে। এই প্রকৃতির কাছে দাঁড়িয়ে আমরা অবিনশ্বরতার কথা ভাবি। জানি, সমস্ত নশ্বর। তবু, জীবন কি তেমন গৃহস্বামী হতে পারে না, যে অতিথিকে বিদায় জানানোর আগে বলবে, আরও কিছুকাল থেকে যাও। আরও কথা বাকি?
আমরা স্মরণ লিখতে চাই না। কারণ আমরা জানি, একজন কবি সে যবেই চলে যান, তিনি বেঁচে থাকেন তাঁর অক্ষরযাপনে। একে একে চলে গেলেন পিনাকী ঠাকুর, মৃণাল সেন, দিব্যেন্দু পালিত, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। একে একে জীবন বিদায় জানালো তাঁদের। তাঁরা দাগ রেখে গেছেন। সময়ের সঙ্গে কিছু কথা বলে গেছেন। তবু কথা তো ফুরোয় না। জীবন যদিও হঠাৎ মাঝপথেই শুরু হয় এবং মাঝপথেই শেষ, তবু কথারা অসমাপ্ত থাকে। কথা ফুরোয় না বলেই, সেই ব্যাটন ধরবার জন্য অপেক্ষা করে থাকে পরবর্তী সময়।
কখনও কখনও এমনও মনে হয়, হয়ত মৃত্যু এমন এক চরিত্র, যার নিজের কোনও মৃত্যুভয় বা বিচ্ছেদজনিত যন্ত্রণা নেই বলেই সে এত অপ্রত্যাশিত, এত নির্মম, এত নির্মোহ। সে জানে, মানুষ, তার নশ্বর জীবনে, শোককে বেশিদিন স্থায়ী হতে দেয় না। কিন্তু মানুষ শোকে ভেঙে পড়ে। মানুষ দুঃখের কাছে মাথা নতজানু করে। মানুষ আকুলিবিকুলি করে। মানুষ হাত পেতে দিয়ে ভাবে, এই যে শূন্যতা তৈরি হল, এ শূন্যতা আর তো পূরণ হবে না। কারো শূন্যতাই পূরণ হয় না বলেই মনে হয় মহাজগতে শূন্যতা এত জায়মান।
কিন্তু আমরা কি মৃত্যুর এই সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের সামনে ভয় পাবো? আমরা কি মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে বলব না, যদি অমরত্ব, অবিনশ্বরতা স্থায়ী না হয়, তবে মুহূর্তের মৃত্যুও স্থায়ী নয়। ওই তো আমি ক্লিক করলাম ভুবন সোমে, ওই তো কলকাতা ৭১ জ্যান্ত হয়ে ঘুরে ফেরাচ্ছে আমার সামনে। ওই তো কলকাতার যিশু পড়তে পড়তে মনের ভিতরে ক্রোধ উঁকি মারছে। ওই তো সহযোদ্ধা পড়তে পড়তে আবার মনে হচ্ছে আমিই সেই কথনের অংশ। ওই তো পড়ছি -
ব্লেড দিয়ে কাটা শিরা, ফোঁটা ফোঁটা মেঝেতে পলাশ
প্রত্যেক রক্তের বিন্দু ফুটে ওঠে বসন্তে, সবুজে
এবার পুলিশ-কেস, কাটাছেঁড়া, মর্গ, ছুটোছুটি
দু চারটে বন্ধু আর হাজার শত্রুর সা রে গা মা
আদরের নৌকোটা ক্ষীণ স্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছি
কাগজের নৌকোটা কালস্রোতে ভাসিয়ে দিলাম
ঢেউ, ধাক্কা, উলটে গেল, ওই সোজা হয়েছে আবারও
কতদূর যেতে পারবে অনিশ্চিত অন্ধকার সব
এত রাতজাগা, প্রুফ, প্রেসের তাগাদা, রক্তফোঁটা
পুরনো, মলাট ছেঁড়া প্রেসিডেন্সি রেলিংয়ের ধারে ...
জেনে যেতে ইচ্ছে করে একশো বছর পর বাংলা বই কেউ পড়বে
কি না?
( আদরের নৌকো, পিনাকী ঠাকুর)
চোখের সামনে ভেসে উঠছে কত বই, কত অক্ষর। তারা তো সকলেই কথা বলে উঠছে। তবে মৃত্যু কী কী কেড়ে নিল? এক নশ্বর দেহের মানুষের সৃজন?
বহু আগে, কবীর সুমনের কাছে জেনেছিলাম নিকারাগুয়ায় ( সম্ভবত, স্মৃতি যদি সমস্যা না করে) বিপ্লবীদের মধ্যে একটি প্রথা প্রচলিত ছিল। যদি কোনও বিপ্লবী মারা যেতেন, তবে যখন সকলে মিলিত হতেন, তখন হাজিরার মতো, তাঁর নাম ধরে ডাকা হত। আর সামনে উপস্থিত যে কোনও বিপ্লবী হাত তুলে বলতেন হাজির। কোথাও যাননি তিনি। হাজির।
চলুন ডাকি তাঁদের।
কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী আছেন?
-এই তো। আছি।
শ্রী মৃণাল সেন?
- যাইনি কোথাও।
কবি পিনাকী ঠাকুর?
-কোথাও যাব না।
সাহিত্যিক দিব্যেন্দু পালিত?
-আছি।
জীবন দুঃখময়। জানি। তবু...
মুহূর্তগুলো খেয়া পারাপার করে। করুক।
আবহমানের পক্ষে
হিন্দোল ভট্টাচার্য




অনেকটা ভরসা পেলাম লেখাটি পড়ে, বিশেষত শেষাংশ থেকে
ReplyDelete